1. admin@shadhin-desh.com : admin :
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৬ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিশু আইন ২০১৩ বাস্তবায়ন শীর্ষক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলা ও দায়রা জজসহ নবনিযুক্ত দুই বিচারককে আইনজীবী সমিতির সংবর্ধনা শেরপুরে হেলমেট না থাকলে মিলবেনা তেল কার্যক্রমের উদ্বোধন নরসিংদীর মনোহরদীতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী হলেন যাঁরা মাদারিপুরে পল্লী বিদ্যুতের ভূতুড়ে বিলে বিপাকে গ্রাহক ফ্রান্স প্রবাসী সালাউদ্দিন প্রাণে মারার হুমকি ও মানহানির কারণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদানে “সচেতনতামূলক” সভা অনুষ্ঠিত নওগাঁয় লিগ্যাল এইডের গণশুনানী অনুষ্ঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের মাসিক কল্যাণ সভা ও মাসিক অপরাধ সভা অনুষ্ঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্লিনিক মালিক সমিতির কমিটি গঠন

পরকীয়া, নৈতিক অবক্ষয় ও আমাদের করণীয়

  • আপডেট সময় : শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০২২
  • ১৭২ বার পঠিত

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

সাম্প্রতিক কালে যেসব সামাজিক ব্যাধি ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পরকীয়া। এটিকে সামাজিক ব্যাধি না বলে ব্যাক্তির চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের চরম রুপ ও বলা যায়। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই অহরহ শোনা যায় পরকীয়ার ঘটনা। আগে যৌতুক, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং অন্যতম সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয় ছিল এখনও আছে তবে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, নতুন নতুন আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ফলে এগুলোর তীব্রতা কিছুটা কমেছে। কিন্তু ইদানিং পরকীয়া মাথাচাড়া দিয়েছে দারুণ হতাশাজনকভাবে। কিভাবে এই সামাজিক রোগ পরকীয়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তার উপায় খুঁজছে সরকার, সুশীল সমাজ এবং মোটা দাগে রাষ্ট্র।তবে এই ব্যাধিটি নিতান্তই ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ও গোপনীয় বিষয় হওয়ায় এটাকে রোধ করা যাচ্ছে না। আর এই পরকীয়ার নিষ্ঠুর বলি হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, বাচ্চা এবং পুরো পরিবারে নেমে আসছে ভয়াবহ বিপর্যয়। কেননা পরকীয়ার ফলে ধাই ধাই করে বেড়ে চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদ। যাতে করে শুধু ব্যাক্তির নয় বরং সম্পর্ক হুমকির মধ্যে পড়ছে পিতা-পুত্রের এবং মাতা ও সন্তানের।

পরকীয়া হলো বিবাহিত কোনো ব্যক্তির (নারী বা পুরুষ) স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহোত্তর বা বিবাহবহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক ও যৌন কর্মকাণ্ড। মানব সমাজে এটি লঘু বা গুরুভাবে নেতিবাচক হিসেবে গণ্য। বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াকে পরকীয়া বলে তা সে ছেলে বা মেয়ে যেই জড়াক না কেন? আমার এই বিষয়ে কেউ যদি মনোকষ্ট পান তাহলে শুরুতে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারণ যে কোন লেখা যদি পাঠক সামগ্রিক দিক বিবেচনায় না নিয়ে ব্যাক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা করে বা নিজের গায়ে নিয়ে নেয় তবে সেটা কারোর জন্য সুখকর নয় না লেখকের না পাঠকের। তাই নিরপক্ষ ও চিন্তার খোরাক জেনে লেখাটি পাঠ করবো। তাতে উভয়েরই মঙ্গল ও কল্যানকর।
এবার একটি ঘটনা বা কেস স্টাডি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি। কবির ও জোসনার (ছদ্মনাম) দাম্পত্য জীবন খুব ভালো চলছিল। হঠাৎ একটি মোবাইল ফোনকল তাদের সুখের সংসারে আগুন ধরিয়ে সন্দেহের দানা বাঁধিয়ে দেয়। কবিরের এক বন্ধু তাকে ফোন করে জানান যে তার স্ত্রী জোসনা অন্য একটি ছেলের সঙ্গে যমুনা ফিউচার পার্কে ঘোরাফেরা করছে। ব্যবসায়ী কবির যমুনা ফিউচার পার্কে তখনই গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে থাকা ছেলেটির পরিচয় জানতে চান। এ সময় কবিরের স্ত্রী উল্টো তাকে প্রশ্ন করেন ‘আপনি কে? আপনাকে তো আমি চিনি না।’

কবির রাগ সামলাতে না পেরে স্ত্রীকে তখন কয়েকটি থাপ্পড় মারেন। নারীর গায়ে হাত তোলার অপরাধে উপস্থিত নিরাপত্তা রক্ষীরা কবিরকে পাকড়াও করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে পুলিশের জেরায় সব সত্য প্রকাশ করেন জোসনা। এসময় জোসনার প্রেমিক পুলিশকে বলেন, ‘জোসনার সঙ্গে আমার এক বছরের সম্পর্ক। অবিবাহিত হিসেবে পরিচয় দিয়েছে আমার কাছে। সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’ এসময় স্বামীকে না চেনার ভান করায় কবিরও জোসনাকে ঘরে নিতে অস্বীকার করেন। ঘটনার কিন্তু এখানেই শেষ নয়! শেষমেশ জোসনা কবিরের কাছে ক্ষমা চায় এবং প্রেমিক ওই পুরুষটি তাকে ভুল বুঝিয়ে এ পথে নামিয়েছে জানিয়ে তার বিচার দাবি করেন। কবির শেষমেশ জোসনার কথামতো ওই প্রেমিক পুরুষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেন।

যাইহোক, কেন পরকীয়া বাড়ছে সেটি আগে খতিয়ে দেখা যাক।যদিও নারী বা পুরুষ যে কেউই পরকীয়ায় জড়াতে পারেন। কিন্তু নারীরা কেন পরকীয়ায় জড়িয়ে যায়, তার কিছু কারণ প্রতিফলিত হয়েছে একটি অনলাইন জরিপে। সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মিলান ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইট চালিয়েছে এই জরিপ। তারা প্রায় চার হাজার নারীর সামনে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে পরকীয়ার কারণ জানতে চেয়েছিল। জরিপে পুরুষসঙ্গীর কয়েকটি আচরণের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে কীভাবে ওই নারীরা পরকীয়ায় জড়িয়েছেন। ওই ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া ও ডেইলি মেইল অনলাইন জানিয়েছে, কেবলমাত্র পুরুষসঙ্গীর প্রতারণার কারণে 70 শতাংশ নারী জড়িয়ে পড়েছেন পরকীয়ায়। আবার দেখা যাচ্ছে, বাকিদের মধ্যে 85 শতাংশ স্বামীর চেয়ে অন্যের (যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান) কাছে উষ্ণ ভালোবাসা পাওয়া—পরকীয়ার একটি অন্যতম কারণ। ওয়েবসাইটটির জরিপে আরও দেখা গেছে, ১. পুরুষসঙ্গীর খারাপ আচরণ, ২. বিশ্বাসঘাতকতা (শুধু এই কারণে অধিকাংশ নারী পরকীয়ায় জড়ান), ৩. কিছু বদ-অভ্যাস, ৪. রাতে অসংলগ্ন আচরণ, ৫. ইচ্ছার মূল্য না দেওয়া, ৬. বারবার মুঠোফোনে নজরদারি, ৭. শারীরিক সংসর্গে অনীহার কারণেই মূলত নারীরা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার দিকে ধাবিত হয়েছেন।

পাশ্চাত্য আধুনিক সমাজে এর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বজায় থাকলেও এটি আইনত অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না, তবে অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরকীয়াকারী ব্যক্তির বিবাহিত সঙ্গী তার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য কোর্টে আবেদন করতে পারেন।
পুরুষ কেন এবং কখন পরকীয়ায় জড়ায় তার কিছু কারণ খুঁজে দেখা যায়- ১. পারিবারিক কলহ, ২. একঘেয়ে সম্পর্ক, ৩. অপূর্ণ প্রত্যাশা, ০৪. আকর্ষণ হারিয়ে ফেলা, ০৫. আকর্ষণ হারিয়ে ফেলা, ০৬. পুরনো অভ্যাস, ০৭. মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণ, ০৮. ডিআরডিফোর জিন, ০৯. মানসিক সমস্যা, ১০. সঙ্গীর উদাসীনতা, ১১. পশ্চিমা সংস্কৃতি, ১২.শখ থেকে পরকীয়া, ১৩. দূরত্ব ও শূন্যতা ১৪. স্ত্রী দূরে গেলে এবং ১৫.সন্তান হওয়ার পর। সঙ্গীর উদাসীনতা ও দূরত্বের কারণেও অনেক সময় মানুষ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী বাস্তবতার কারণে, কাজের কারণে হয়তো দূরে চলে যায়। তখন তাদের মধ্যে পরকীয়ার আগ্রহ বাড়ে। অনেক সময় পশ্চিমা সংস্কৃতির ধাঁচ নিজেদের মধ্যে আনতে চায়, তখন পরকীয়া বাড়ে। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, দূরত্ব ইত্যাদির জন্যও অন্যের প্রতি আগ্রহ, আসক্তির ঘটনা ঘটে। অনেকে শখ থেকেও পরকীয়ায় জড়ায়। অন্য আরেকটি শরীর কেমন, একে জানার একটি আগ্রহ থাকে। অনেকে আবার ভাবে, ‘ওরা কি সুখী! এই মানুষটির সঙ্গে থাকতে পারলে হয়তো আমার অনেক সুখ লাগত।’ এ থেকেও অনেকে ওই ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ অনুভব করে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন শূন্যতা তৈরি হয়, তখন আরেকজন সেখানে প্রবেশ করে। হয়তো স্বামী বা স্ত্রীর আর আগের মতো করে কথা বলে না বা আদর করে না। যত্ন কম নেয়। এই বিষয় গুলোর কারণে অন্যের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়।

শখ থেকেও অনেকে পরকীয়ায় জড়ায়। অন্য আরেকটি শরীর কেমন, একে জানার একটি অসৎ চাহিদা বা ইচ্ছা থাকে। অনেকে আবার ভাবে, ‘ওরা কি সুখী! এই মানুষটির সঙ্গে থাকতে পারলে হয়তো আমার অনেক সুখ লাগত।’ এ থেকেও অনেকে ওই ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ অনুভব করে। অনেক সময় পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে নিজেদের মধ্যে আনতে চায়, তখন পরকীয়া বাড়ে। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিণ্য, দ্বন্দ্ব, দূরত্ব ইত্যাদির জন্যও অন্যের প্রতি আগ্রহ, আসক্তির ঘটনা ঘটে। মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়ায়। শুরুতে আসে দৈহিক চাহিদা মতো বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্কে অতৃপ্তি থেকে অনেকে এ সম্পর্কে জড়ায়। শারীরিক সম্পর্ক মানুষের একটি শারীরবৃত্তীয় জৈবিক চাহিদা। যদি স্বামী-স্ত্রীর যৌনজীবন দুর্বল হয়, তাহলে অপর ব্যক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হতে পারে। কারো মধ্যে যদি ডিআরডিফোর (DRD4) জিনের উপস্থিতি বেশি হয়, তাদেরও পরকীয়া বা বাড়তি সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা থাকতে পারে।

মানসিক সমস্যার কারণেও মানুষ পরকীয়ায় জড়াতে পারে। যাদের মধ্যে বাইপোলার মুড (Bipolar Mood) সমস্যা রয়েছে, তাদের পরকীয়ার সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। তারা কোনো কিছুর মধ্যে স্থিরতা খুঁজে পায় না। পারিবারিক কলহের কারণে অনেক সময় পুরুষ পরকীয়ায় জড়ায়।সংসারজীবন সব সময় মধুময় হয় না। ঝগড়া থেকে শুরু করে গায়ে হাত তোলার ঘটনা ঘটে। তাই স্ত্রীর সঙ্গে যখন সম্পর্কের অবনতি ঘটে তখন বেশির ভাগ পুরুষ অন্য জায়গায় আশ্রয় খোঁজে এবং পরকীয়ার জড়ায়। পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষই প্রেম বা বিয়ের সম্পর্ককে বেশিদিন আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেন না। জীবনভর একই ছাদের নিচে থাকেন বটে, তবে সংসারের নিয়মে। সংসার নামক বন্দিজীবনে একটুখানি বৈচিত্র্যের ছোঁয়া পেতে অনেক পুরুষরা আকৃষ্ট হন অন্য নারীদের প্রতি। সঙ্গীর কাছ থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা থাকে নারীর। অনেক আশা করে বিয়ে করেছেন, কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি। এমন ক্ষেত্রে পুরুষরা শুরু করেন নতুনের খোঁজ। অনেকেই নিজের সঙ্গীর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। প্রতিদিন একই চেহারা, একই আচরণ মনে হতে থাকে। তাই অন্য নারীর দিকে নজর চলে যায়। বিয়ের আগেও অনেক স্ত্রীর অভ্যাস থাকে একসঙ্গে একাধিক সম্পর্ক বয়ে চলা। তাই স্ত্রী যতই উপযুক্ত হোক না কেন, দৃষ্টি গড়ায় নতুনের খোঁজে। পুরনো অভ্যাস তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। স্ত্রী দূরে থাকলেও এ সমস্যা হতে পারে। শুধু যৌনতায় অংশগ্রহণ নয়, কথাবার্তায়ও বিষয়টি থাকতে হয়। তখন যদি অন্য কেউ সেই কথাগুলো শোনায়, তাহলে তার প্রতি আগ্রহ কাজ করে। সন্তান হওয়ার পর অনেক মেয়ে স্থূল হয়ে যায়। এতে স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে। আবার নারীর বেলায়ও অনেকে হয়তো খুব হ্যান্ডসাম ছেলে পছন্দ করে, যা হয়তো তার স্বামীর সঙ্গে মেলে না। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক প্রয়োজন মেটানোর বিষয়টিই এখানে মুখ্য হয়। এসব ভাবনা ব্যক্তিকে পরকীয়ার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে।

এখন পরকীয়া বিষয়ে আইন-কানুনে কি আছে বা পরকীয়া অপরাধ কিনা বা তার শাস্তি কি তা জানানোর চেষ্টা করবো। পরকীয়ার সাজা সংক্রান্ত দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা কেন অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। রিটে ৪৯৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনার আবেদনও রয়েছে।

দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী কোনো স্ত্রী পরকীয়া করলে যার সঙ্গে পরকীয়া করবে শুধু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। অথচ স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর কিছুই করার নেই। একইভাবে স্বামী পরকীয়া করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে বা যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত হবে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার পাবেন না। উপরন্তু স্বামী যদি কোনো বিধবা বা অবিবাহিত নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন এবং স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে পরকীয়ায় জড়িত হয় তা আইনত বৈধ। এই আইন সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এটা অদ্ভুত ও বৈষম্যমূলক।
এর আগে ‘পরকীয়া ফৌজদারি অপরাধ নয়, ইংরেজ শাসনকালে তৈরি এই আইনের ৪৯৭ ধারা অসাংবিধানিক’- এমনটিই রায় দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, এই আইন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। মহিলাদের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করে। স্বামী কখনই স্ত্রীর প্রভু বা মালিক হতে পারেন না। তবে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে বলে মত দিয়েছেন। ব্রিটিশদের তৈরি করা ১৮৬০ সালের আইনকে চ্যালেঞ্জ করে একটি মামলার প্রেক্ষিতেই শীর্ষ আদালত এই রায় দিয়েছেন। রায়ের পর থেকেই সাংবাদিক, আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ মানুষ গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে টেলিভিশন টক শো ও পত্রিকার কলাম পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরও কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক।
বিজ্ঞ আইনজীবী পিএম সিরাজুল ইসলাম প্রামাণিক তার কলামে লিখেছেন-১৮৬০ সালে তৈরি ওই আইনের ৪৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। বিবাহিত নারীকে ‘অপরাধের শিকার’ বিবেচনা করে আইনে সম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষকেই দোষী হিসেবে গণ্য করার বিধান ছিল। এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন জনৈক যোশেফ শাইন। তবে শীর্ষ আদালত বলেছেন, পরকীয়া সম্পর্কের কারণে জীবনসঙ্গী যদি আত্মহত্যা করেন এবং আদালতে যদি তার প্রমাণ দাখিল করা যায় তবেই এটি অপরাধে প্ররোচনা হিসেবে গণ্য হবে। অন্যদিকে সরকারি কৌঁসুলিরা ‘বিয়ের পবিত্রতা’ রক্ষার স্বার্থে আইনটি বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন।

ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ১৯৭৯ সালের হুদুদ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী পরকীয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে। তবে এ ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে মহিলাদের শাস্তির পরিমাণ বেশি রাখা হয়েছে। ফিলিপিন্সে পরকীয়া এখনো অপরাধ। স্ত্রী আর তার সঙ্গীর ৬ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে, যদি তার স্বামী প্রমাণ করতে পারেন যে, ওই পার্টনারের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রয়েছে তার স্ত্রীর। অন্যদিকে আবার স্বামীর অন্যকোনো মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক যদি স্ত্রী প্রমাণ করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে স্বামীর ১ দিন থেকে সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে ৪ বছর। মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরবে পরকীয়াকে বিরাট অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। স্বামী বা স্ত্রী যে কারও অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানা, নির্বিচার আটক, জেল, মারধর এমনকি মৃতু্যদন্ডের বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের শাস্তির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো লোকের স্ত্রী জানা সত্ত্বেও বা সেটা বিশ্বাস করার অনুরুপ কারণ রয়েছে এমন কোনো নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন এবং অনুরূপ যৌনসঙ্গম যদি ধর্ষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন, যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যাবে। এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতাকে অন্য লোকের স্ত্রী হতে হবে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই। ওই স্ত্রীলোকটি যে দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী বা ব্যভিচারের অপরাধে দোষী অথচ তিনি কোনো সাজা পাবে না। এ বিষয়ে মহামান্য লাহোর হাইকোর্ট একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, যা পাকিস্তান লিগ্যাল ডিসিশন, ১৯৭৪ সন্নিবেশিত রয়েছে। মহিলা আসামি হতে পারে না। তবে ওই পুরুষটির সাজা দিতে হলে অভিযোগকারীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, ওই মহিলার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করার সময় আসামি জানত অথবা জানার যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল যে, যৌন সঙ্গমকারী মহিলা অন্য কোনো ব্যক্তির স্ত্রী।
বলে রাখা ভালো যে, কোনো মহিলাকে তার আগের স্বামী তালাক দিয়েছেন এই সরল বিশ্বাসে আসামি বিবাহ করলে তাকে এ ধারার অধীন দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে মহিলার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করা হয় সে মহিলা ওই সময় বিবাহিত না হলে এই ধারার অধীনে কোনো অপরাধ আমলে আনা যায় না। এ ধারা অধীন শাস্তি দিতে হলে বিবাহের বিষয়টি যথাযথভাবে প্রমাণ করতে হয়। উপরন্তু মহামান্য লাহোর হাইকোর্ট বলেছে, অবিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীলোক যদি দীর্ঘদিন ধরে একত্রে বসবাস করে তাহলে বলা যাবে না, তারা ব্যভিচারের অপরাধ করেছে। (পিএলডি ১৯৬২, ৫৫৮)।

দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য, অভিযুক্ত প্রেমিক পুরুষ আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণপূর্বক জামিনের আবেদন জানান এবং বিচারক মহোদয় তাকে জামিন দেন। এ মামলায় আসামিকে সাজা দিতে হলে বাদীকে পাঁচটি বিষয় অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। প্রথমত আসামি কোন নারীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করেছিল, দ্বিতীয়ত, ওই নারী বিবাহিত ছিল, তৃতীয়ত, আসামি বিবাহের বিষয়টি জানত এবং তা বিশ্বাস করার কারণও ছিল, চতুর্থত, ওই যৌন সঙ্গম নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে হয়েছিল, পঞ্চমত, ওই যৌন সঙ্গম নারী ধর্ষণের সামিল ছিল না। আবার সাক্ষ্য আইনের ১০১ ধারামতে কোনো ঘটনা প্রমাণের দায়িত্ব বাদীর। গোপাল চন্দ্র বনাম লাসমত দাসী মামলা যা ৩৪ ডিএলআর, ১৪৫ পৃষ্ঠায় উলেস্নখ রয়েছে যে, বিচার্য বিষয় সম্পর্কে যে পক্ষ কোনো ঘটনার অস্তিত্বের দাবি করে সে পক্ষই তা প্রমাণ করবে।
এ মামলায় আসামি যে জোসনার সঙ্গে ব্যভিচারী করেছে, বাদী কবির প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় বিচারিক প্রথম শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পাঁচ বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড, সেই সঙ্গে অর্থদন্ডেও দন্ডিত করে রায় প্রদান করেন।
ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে ইসলাম ধর্মে পরকীয়া বা ব্যাভীচারির শাস্তি কঠিন থেকে কঠিনতর। ইসলামি রাষ্ট্রসমূহে এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যা হলো পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান। মনোচিকিৎসায় এ কথা স্বীকৃত যে, বাবা-মার পরকীয়া সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এবং সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সন্তানের মানসিক বিষণ্ণতার ও আগ্রাসী মনোভাবের জন্ম দেয়। এছাড়া পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতিতে পরকীয়া প্রভাব রাখে। পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ও পরকীয়া রোধ করতে ধর্মের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি বলে মনে করি। নৈতিক শিক্ষা জোরালো করার মাধ্যমে নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি হলে পরে পরকীয়া কমতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো, যুগান্তর, যায়যায়দিন পত্রিকা এবং পেনাল কোড ও অন্যান্য আইনের বইসমূহ।

লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, কলামিস্ট, কবি ও আইন গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

© All rights reserved © 2022 © Shadhin Desh
Theme Customized By Theme Park BD
error: Content is protected !!