ইসতিয়াক আহমেদ হিমেল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঃ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, সংবিধানের শেষ রক্ষাকবচ বিচার বিভাগ। বিচারক ও আইনজীবীরা সেই বিচার বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বার ও বেঞ্চ হচ্ছে একে অপরের পরিপূরক। বিচারক ও আইনজীবীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা সকল পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশ, জনগণ ও আদালত। আদালতের সম্মান রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব আইনজীবীদের। এরপর বিচারকের ও নাগরিকের। সকলকে ধৈর্যশীল, ন¤্র ও সহনশীল হতে হবে। আইনজীবীদের মর্যাদাপূর্ণ হতে হবে। বিচারকদের আইনজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, ‘দ্রুত সময়ে বিচারকাজ নিষ্পত্তি করতে বিচারক ও আইনজীবীদের সহযোগিতা করতে হবে। আদালতের দ্বারে ঘুরতে থাকা সন্তানহারা বাবা ও অসহায় নিরীহ নির্যাতিতদেরকে উভয়পক্ষই সহযোগিতা করবেন।’ গত শনিবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইনজীবীরা আদালত বর্জনসহ বিচারককে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমন করছেন। ধারাবাহিকভাবে এটা ঘটলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বেড়ে যাবে। প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘কোনো বিচারকের প্রতি অভিযোগ থাকতেই পারে। আইনজীবীরা আমার নিকট অভিযোগ দেবেন। আমি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। সংশ্লিষ্ট সকলকে মনে রাখতে হবে, জুডিশিয়ারি যেন এগিয়ে যায়। আমরা দুর্বলকে সাহায্য করব। তাদের নিরাপদ থাকতে দেব। আমরা সকলে মিলে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করব, যাতে জুডিশিয়ারি এগিয়ে যায়। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭১ সালের রক্তদান যেন বৃথা না যায়। দরিদ্রতা, দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়ব। বিচারের বাণী যেন নিভৃতে না কাঁদে। প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, বিচারসংশ্লিষ্ট সকলকে নৈতিক মান বজায় রাখতে হবে। অনৈতিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আইন ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একজন ভালো আইনজীবী মক্কেলের কথা ভালো করে শুনবেন। তার কাগজ ভালো করে দেখবেন। এরপর মামলাটি সুন্দরভাবে আদালতে উপস্থাপন করবেন। আইনজীবীরা সিদ্ধান্ত দেবেন না। সে দায়িত্ব বিচারকের। আইনজীবীরা বিচারককে সর্বোতভাবে সাহায্য করবেন। যত দ্রæত সম্ভব মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। বিচারপ্রার্থীকে মানবিকভাবে দেখবেন। আরো বলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সমাজ গঠন ও এর বিকাশ প্রক্রিয়ায় এবং মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে আইনজীবীদের ভুমিকা সবসময় ছিল অপরিহার্য। বিশেষ করে অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বে আইনজীবীরা অতুলনীয় অবদান রেখে গেছেন। তারা অধিকাংশই ছিলেন আইনজীবী। ভারতের কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি ছিলেন, উমেস চন্দ্র বানার্জী। তিনি ছিলেন পেশায় আইনজীবী। তিনি আরও বলেন, বিগত আড়াই’শ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে- সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ প্রত্যেকটি অঙ্গনের কর্মকান্ডে জড়িয়ে ছিলেন আইনজীবীগণ। বঙ্গবন্ধুর পিতাও তার ছেলে (বঙ্গবন্ধু)’কে আইনজীবী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাটি ও মানুষের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আইন বিষয়ে পড়া হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের আইনজীবীদের স্বর্ণোজ্জ্বল ভুমিকা অতুলনীয়। বাংলাদেশের সংবিধান প্রনেতা ছিলেন, আইনজীবী। আমাদের লক্ষ্য স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে সুবিচার নিশ্চিত করা।’ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন আপিল বিভাগের বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম, আইন কমিশনের সদস্য বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর। সভায় সভাপতিত্ব করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জবদুল হক। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান, জেলা ও দায়রা জজ মোহা. আদীব আলী, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কুমার শিপন মোদক, জেলা প্রশাসক এ কে
এম গালিভ খাঁন, পুলিশ সুপার এএইচএম আব্দুর রকিব। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. রবিউল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম কনক। এর আগে সকালে শোভাযাত্রা, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বেলুন-পায়রা উড়িয়ে শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীদের বিশ্রাম ও বসার সুবিধার্থে ‘ন্যায়কুঞ্জু’ ভবন নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রধান বিচারপতি। পরে আদালত চত্বরে দুটি আম গাছ ও একটি কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ রোপণ করেন প্রধান বিচারপতি।
Leave a Reply