কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি :
কুড়িগ্রামের উলিপুরে উঁচু জমি গুলোতে বৃষ্টির পানি সংকট দেখা দিলে আমন চাষ করতে নির্ভর হতে হচ্ছে সেচের উপর। বিঘা প্রতি খরচ হচ্ছে দ্বিগুন। আমন চাষিদের প্রত্যাশা ছিল এবারের আষাঢ়ে তেমন বৃষ্টি না হলেও শ্রাবণে বৃষ্টি হবে। আর তখনই তারা আমন রোপণের কাজ সেরে ফেলতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু এবারে সেই চিরচেনা বাংলার রূপ ছিল অনেকটাই অচেনা। আবহাওয়ার বৈরী আচরণের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টি না হয়ে বরং তীব্র খরার মধ্যে চলছে শ্রাবণ। আর যেটুকু বৃষ্টি হয়েছে তা ছিল কৃষকদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। এমন পরিস্থিতির মধ্যে জমি ও বীজতলা প্রস্তুত রেখেও অনাবৃষ্টি আর তাপদাহের কারণে শুষ্ক মাটিতে আমন রোপণ করতে পারছেন না কৃষকরা। অনেকে সেচ যন্ত্রের মাধ্যমে আমনের চারা রোপণ শুরু করেছেন।
উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলার পৌরসভাসহ ১৩ টি ইউনিয়নের রোপা আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২৪ হাজার ৫শ হেক্টর। এ পর্যনÍ অর্জিত ১৮ হাজার ৫‘শ হেক্টর। যা লক্ষ্য মাত্রা অর্জন চলমান রয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে মাঠপর্যায়ে রোপা আমন চাষিদের বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দেয়া অব্যহত রয়েছে।
সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আমন চাষিরা আমনের চারা রোপন করতে জমিতে বৃষ্টির পানি না থাকায় সেচের পানি দিয়ে রোপা আমন চাষ করতে ব্যাস্ত সময় পার করছেন। পানির অভাবে আমন চাষ ব্যাহত হচ্ছে। সেচ দিয়ে চাষ করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন চাষিরা। আমন চাষ বৃষ্টি নির্ভর হওয়ায় বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিলেন কৃষকরা। বর্ষা মৌসুম, জমিতে পানি নেই। বিলম্বে বিকল্প ব্যবস্থায় অগভীর নলকূপের (শ্যালো মেশিন) সেচ দিয়ে আমন চাষ করছেন কিছু কিছু চাষি। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রভাব পড়েছে আমন মৌসুমের প্রান্তিক চাষিদের উপর। ফলে দেনার উপর দেনা কাঁধে নিয়ে কষ্টের শেষ সীমা অতিক্রম করছেন চাষিরা। জানা যায়, বৃষ্টির মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় এবং রোদের প্রখর তেজের কারণে সংকুলান হচ্ছে না সেচে। শুকিয়ে যাচ্ছে রোপা আমন ক্ষেত। ফলে বাড়ছে চাষের খরচ।
উপজেলার পৌরসভার নাড়িকেলবাড়ি এলাকার কৃষক লুৎফর রহমান (৫৬) বলেন, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস হচ্ছে আমন রোপণের সময়। কিন্তু বৃষ্টি না থাকায় জমির মাটি শুকনো হয়ে আছে। ফলে জমি ও বীজতলা প্রস্তুত থাকলেও আমনের চারা রোপণ করতে পারছি না। একই মাঠে কথা হলে রফিকুল ইসলাম ট্রাক্টর চালক বলেন, সকালে জমি চাষ করতে ক্ষেতে আইছি। এসে দেখি জমিতে পানি নেই। সেচ দিয়ে পানি দেয়ার পর জমি প্রস্তুত করে দিলাম। আমন চাষিরা আরও জানান, এক কাঠা জমি চাষ করতে ট্রাক্টর খরচ লাগে ৯০ টাকা। ধান রোপণ হলে ক্ষেত চাষ করতে হয় চারটা। এতে খরচ হয় ৩’শ ৬০ টাকা। আর মোটর সেচ খরচ ঘন্টা প্রতি আগে ১’শ টাকা থাকলেও তা এখন বেড়ে ১’শ ৫০ টাকা হয়েছে। এর পর ক্ষেত লাগাতে জন প্রতি শ্রমিকে খরচ হয় ৩’শ ৬০ টাকা থেকে ৪’শ টাকা। এর বাইরে সার-বীজ আর ক্ষেত নিড়ানির খরচ তো আছেই। কিন্তু বৃষ্টি হলে খরচটা কম লাগতো।
স্থানীয় কৃষক আশরাফ আলী খন্দকার (৬৫) বলেন, জমি ও বীজতলা তৈরি, রোপণ, নিয়মতি সেচ, কীটনাশক প্রয়োগ, দুইবার আগাছা বাছাই, সার দেওয়া থেকে ধান মাড়াই পর্যন্ত এক বিঘা জমিতে মোট খরচ হয় প্রায় ১৯ হাজার টাকা। এর পর বিঘা (৩৩ শতক) প্রতি জমিতে ধান উৎপাদন হতে পারে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ মণ। যার বাজার মূল্য ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা। তাই লাভের আশা ছেড়ে দিয়ে শুধু ঘরের ভাত খাওয়ার আশায় আমন চাষ করছি। চড়া বাজারে চাল কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্য আরও অনেক কৃষকেরই নেই। তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতেও সরকার যদি কৃষকের চাষাবাদ খরচ ও ধানের দামে সমন্বয় না করে তাহলে কৃষক সমাজ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।
উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নে লাঠির খামার এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, প্রতি ঘণ্টায় ১’শ ৫০ টাকা হিসাবে সেচ দিয়ে জমি ভেজাতে হচ্ছে। দুই একর জমি থাকলেও অর্ধেকের বেশি জমিতে চাষ হয়নি। আগের তুলনায় পাঁচগুন খরচ বৃদ্ধি হওয়ায় ১ একর জমিতে রোপা আমন ধানের চাষ করছেন। এখনো আমন চাষ করা বাকি রয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদ মোশারফ হোসেন বলেন, আমন চাষ সাধারণত বৃষ্টি নির্ভর হয়ে থাকে। কিন্তু এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় উঁচু জমি গুলোতে কিছুটা সেচ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সেচ নির্ভর হয়ে গেছে আমন রোপণের কাজ। আশা করছি, রোপা আমন ধানের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা ছাড়িয়ে যাবে।
Leave a Reply